বর্তমানে অভ্যন্তরীণ কঠিন সংকটে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জুলাই আগস্টের বিপ্লবের প্রায় ৬ মাস অতিবাহিত হবার পরও দলটি অদ্যাবধি সাংগঠনিক অবস্থান জানান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপশি দলটির সকল স্তরের নেতাদের মধ্যে বিভক্তি তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে দলের মূল শক্তি তৃণমূল ও মধ্যম সারির নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানান ক্ষোভ এবং হতাশা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা দলকে সাংগঠনিক কাঠামোয় আনার ব্যাপারে দৃঢ় ও বলিষ্ঠ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের আবেদন-নিবেদনকে কেন্দ্রীয় নেতারা আমলে না নেয়ায় দলের ভবিষৎ নিয়ে তারা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কালাতিপাত করছেন। একদিকে হত্যাকাণ্ডের মতো মামলা। অপরদিকে বৈরী পরিবেশ। এমন অবস্থায় তৃণমূলসহ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিত নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় সর্বসাধারণের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নানা গুজবের ডালপালায় বিচরণ করেই তাদের এখন সংকট মোকাবেলা করে চলতে হচ্ছে। খবর একাধিক বিশ্বস্ত সূত্রের।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের নেতৃতের সংকট ও বিভক্তির কারণে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম তলানিতে চলে গেছে। যে কারণে দলটির ঐক্য ও সংহতি দুর্বল হয়ে নেতৃত্বের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়েছে। এহেন বিভক্তি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেকেই গেলো। দলটির নেতাসহ বিশিষ্টজনের সাথে আলাপে জানা গেলো সংকট থেকে উত্তরণ ও ভবিষৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে করণীয় বিষয়ে।
আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, যা বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার নিষিদ্ধ করেছে। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সংগঠনটির এক নেতা বলেন, নাটকীয় (হাসিনার) পালানোর ঘটনা যখন টিভিতে প্রচার করা হচ্ছিল, তখনও আমি কয়েকজন নেতা-কর্মী নিয়ে খুলনার রাজপথে ছিলাম। আমি আমাদের জ্যেষ্ঠ নেতা, স্থানীয় সংসদ সদস্যকে ফোনকল করার চেষ্টা করেছি কিন্তু তাদের ফোন বন্ধ ছিল। সে মুহূর্তে আমি প্রতারিত বোধ করেছি। খুলনার একসময়ের এ প্রভাবশালী ছাত্রলীগ নেতা নিরাপত্তার শঙ্কায় তার পালিয়ে বেড়ানোর কষ্টকর যাত্রা বর্ণনা করেছেন। মিথ্যা পরিচয়ে তিনি ঢাকায় স্থানান্তরের আগে পার্শ্ববর্তী জেলা গোপালগঞ্জে ছিলেন কিছুদিন। তিনি বলেন, আমি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, ফোন নম্বর এবং সবকিছু পরিবর্তন করেছি। আমি বেঁচে থাকার জন্য একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেছি। দল আমাদের পরিত্যাগ করেছে। আমি আর কখনো রাজনীতিতে ফিরব না। রাজনীতি ছাড়ার অনুরূপ বক্তব্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তৃণমূল কর্মীরা জানিয়েছেন। অনেক নেতা নীরব থাকলেও বাংলাদেশ কৃষক লীগের সহসম্পাদক সামিউল বশির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতিশ্রুতিশীল কর্মীরা বছরের পর বছর ধরে অবহেলিত থেকেছে। ২০১৪ সাল থেকে সুবিধাবাদী ও স্থানীয় আইনপ্রণেতাদের পরিবারের সদস্যরা তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কাঠামোতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। যা দলকে এ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসক সংগঠনের এক নেতা একই রকম হতাশার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যারা দলের মুখ হয়ে উঠেছিল, তাদের কাজ ও বক্তব্যগুলো বিপর্যয়কর ছিল, বিশেষ করে গত কয়েক বছরে। দলের ব্যর্থতার প্রতিফলন তুলে ধরে তিনি বলেন, একটি কঠিন বাস্তবতা হলো আমাদের দল সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল ছিল। অনেক শীর্ষ নেতাই জানতেন না, কীভাবে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হচ্ছিল এবং কারা সেগুলো নিচ্ছিল।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবেও দলটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়ে। গত এক দশকে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সব তৃণমূল ইউনিটে কোনো পরিবর্তন আসেনি, পুরনো নেতাদের ওপরেই নির্ভর করত। ‘জুলাই আন্দোলন’ নামে পরিচিত ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনের সময় সরকারের নেয়া কঠোর পদক্ষেপের দায় স্বীকার করে আওয়ামী লীগ এখনও আনুষ্ঠানিক ক্ষমা বা বিবৃতি দেয়নি। বিপরীতে দলটি বিবৃতি দিয়ে বারবার আন্দোলনকে অস্বীকার করেছে। তাদের যুব সংগঠন যুবলীগ ১০ জানুয়ারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসীদের বিদ্রোহ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। দেশকে ‘পাকিস্তানি আদর্শের’ দিকে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্যে এটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম গত ১৬ জানুয়ারি অজ্ঞাত স্থান থেকে টেলিফোনে বলেন, আমরা একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। এটা শিগগিরই প্রমাণিত হবে। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে কোটাবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হিসেবে দেখিয়ে ‘বিভ্রান্ত’ করার জন্য বারবার অভিযোগ করেছেন। তিনি স্বীকার করেন, তার দল ‘কৈৗশলগত ভুল’ করেছে। কিন্তু এ ব্যর্থতার জন্য প্রাথমিকভাবে ‘গোয়েন্দা ত্রুটিকে’ দায়ী করেন তিনি। তবে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত ১১ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, আওয়ামী লীগ ‘ইসলামী সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনী’ পরিচালিত ‘যৌথ অভ্যুত্থানের’ শিকার হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অন্যরা অবশ্য এ দাবির সঙ্গে একমত নন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ দলের মধ্যে জবাবদিহির অভাবকে দায়ী করেছেন। তিনি একটি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, অন্যায়, নিপীড়ন, দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন ও পাচারের জন্য আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আমি এখনও তাদেরকে কোনো আত্মোপলব্ধি, আত্ম-সমালোচনা বা অপরাধ স্বীকার করতে দেখিনি।
এ বিষয়ে জাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, দলটির কট্টরপন্থি অবস্থান এবং সিদ্ধান্ত জনগণের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছিল এবং বিদ্রোহে সাফল্য অর্জনের পথকে প্রশস্ত করে দিয়েছিল। অতি-উৎসাহী পদক্ষেপগুলো শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তায় আঘাত করে, তার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে পরিণত করে। তিনি বলেন, এবার অবশ্য (প্রেক্ষাপট) ভিন্ন। দলটি সেনা সমর্থিত রক্তক্ষয়ী ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহের মুখে পড়েছে। (পালিয়ে যাওয়ায়) একজন নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। আওয়ামী লীগ ভাবমূর্তি ও নেতৃত্ব সংকটের মধ্যে রয়েছে। অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, আওয়ামী লীগ তীব্র ভাবমূর্তি ও নেতৃত্বের সংকটের সম্মুখীন। শেখ হাসিনাকে ছাড়া দল পুনর্গঠন করা চ্যালেঞ্জিং হবে এবং দলের ভেতরেও বিভক্তির সম্ভাবনা রয়েছে।
গত ২৫ জানুয়ারি এক সমাবেশে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, আওয়ামী লীগকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হবে না। এখনও আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখেছেন, যদিও তারা মাঝে মাঝে ব্যক্তিগতভাবে হাসিনার পরিবারের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহারের সমালোচনাও করেন। বিদেশে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কর্মীদের পুনরায় সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন এবং বার্তা দিচ্ছেন, ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হতে চলেছে। তবে এই বার্তা দলীয় কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করা কঠিন। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এই ধরনের বক্তব্যের নিচে মন্তব্য বিভাগে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের মধ্যম সারি ও তৃণমূল নেতাকর্মীরা এতে আস্থা রাখতে পারছেন না। তাদের ভাষ্য, দেশ ছেড়ে যাওয়া নেতাদের পক্ষে বিদেশে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে কথা বলা সহজ। কিন্তু মাঠে কর্মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এবং পলাতক রয়েছেন। খুলনার সাবেক ওই ছাত্রনেতার মতো অনেকেই নিজেদের পরিচয় প্রকাশ্যে আনতে ভয় পাচ্ছেন। তাদের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন অনেক দূরের বিষয় বলেই মনে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরতে ২১ বছর লেগেছিল। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করতে ও নেতৃত্ব দিতে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন শেখ হাসিনা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

অভ্যন্তরীণ কঠিন সংকটে আ’লীগ
- আপলোড সময় : ২৮-০১-২০২৫ ১১:৫৯:২১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৮-০১-২০২৫ ১১:৫৯:২১ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ